
গাজা, ফিলিস্তিন
যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার আরেকটি প্রাণ ঝরে গেল। তবে এই মৃত্যু যেন শুধুই একটি নামের সংযোজন নয়, বরং একটি জীবন্ত প্রতিচ্ছবি, এক সাহসী আত্মার গল্প, এক প্রতিশ্রুতিশীল আলোকচিত্রীর নির্মম বিদায়। মৃত্যুর আগে তিনি লিখে গিয়েছিলেন:
“যদি আমি মারা যাই, তাহলে আলোড়িত মৃত্যুই চাই—যে মৃত্যু মানুষকে ভাবাবে, নাড়া দেবে, জাগাবে।“
তিনি ছিলেন একজন ক্যামেরার সৈনিক
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার তরুণ আলোকচিত্রী মোস্তফা থাবেত (Mustafa Thabet) ছিলেন একজন চিত্রসাংবাদিক, যিনি প্রতিদিনের যুদ্ধ, ধ্বংসস্তূপ আর কান্নার দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করতেন। তার ছবি ছিল কেবল চিত্র নয়, একেকটি গল্প, একেকটি প্রতিবাদ।
তিনি কাজ করতেন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের জন্য, যেখানে তার তোলা ছবি বিশ্বের বিবেককে নাড়া দিয়েছে বহুবার। হাসপাতালের করিডোর, ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ির ধুলো, কিংবা বাবা-মাকে খুঁজে বেড়ানো এক শিশুর মুখ—এই সবই ছিল তার ক্যামেরায় ধরা পড়া বাস্তবতা।
শেষ পোস্ট: এক অভিমানের আত্মকথন
মৃত্যুর ঠিক কয়েক ঘণ্টা আগে তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি হৃদয়বিদারক পোস্ট দেন। তিনি লেখেন:
“যদি আমি মারা যাই, আমি চাই তা যেন কেবল সংখ্যা না হয়। আমি চাই, আমার মৃত্যু মানুষকে চিন্তায় ফেলুক। আমি চাই, আমার ক্যামেরার চোখ বাঁচুক, আমার কণ্ঠ যেন কখনো থেমে না যায়।“
এই পোস্টে তিনি জানান, প্রতিদিন মৃত্যুর খুব কাছাকাছি থেকে বেঁচে ফিরছেন। বাঁচার ইচ্ছা থাকলেও, গাজায় বাঁচার নিশ্চয়তা নেই। তিনি শুধু চেয়েছিলেন—তার মৃত্যু যেন কিছু বলে যায়।
মৃত্যু সেই রাতেই এসে হাজির হয়
তার পোস্টের পরদিনই, ইসরায়েলি বিমান হামলায় তিনি নিহত হন। সংবাদ সংগ্রহের সময় একটি ভবনের ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে তার মৃত্যু ঘটে। তার সহকর্মীরা জানান, তিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ছবি তুলছিলেন—এক মা তার মৃত শিশুকে জড়িয়ে কাঁদছিলেন, সেই দৃশ্যটি ছিল তার ক্যামেরার শেষ ক্লিক।
বিশ্বজুড়ে প্রতিক্রিয়া
মোস্তফার মৃত্যুতে বিশ্বজুড়ে সাংবাদিক সমাজ, মানবাধিকার কর্মী এবং সাধারণ মানুষ শোকাহত। বহু আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম তার মৃত্যুকে “সাংবাদিকতার লড়াইয়ে এক নায়কোচিত মৃত্যু” বলে অভিহিত করেছে।
সংবাদ সংস্থা Reporters Without Borders এক বিবৃতিতে বলে, “গাজায় সাংবাদিকদের মৃত্যু কেবল একটি মানুষের মৃত্যু নয়, সত্যের আরেকটি জানালা বন্ধ হয়ে যাওয়া।“
যে আলো নিভে গেল, সে আলো আরও বহু চোখে জ্বলে উঠবে
মোস্তফা থাবেতের মৃত্যু তার নিজের ইচ্ছার মতোই “আলোড়িত” হয়েছে। তার শেষ পোস্ট এখন লাখো মানুষের টাইমলাইনে ছড়িয়ে পড়েছে। তার ক্যামেরার গল্প, তার তোলা ছবিগুলো আজ আরও অর্থপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তিনি হয়তো চলে গেছেন, কিন্তু তার চোখ দিয়ে দেখা গাজার ইতিহাস রয়ে গেছে।
উপসংহার:
মোস্তফার মতো আলোকচিত্রীরা কেবল ছবি তোলেন না তারা ইতিহাস লিখেন, যন্ত্রণার সাক্ষী হন। তাদের সাহস, তাদের শব্দ, এবং তাদের চিত্র আমাদের মানবতা জাগিয়ে রাখে। গাজার মাটিতে আরও অনেক মোস্তফা আজও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সত্যের খোঁজে ক্যামেরা চালাচ্ছেন। আর আমরা যেন তাদের গল্প শুনি, তাদের মৃত্যুকে সংখ্যা না বানিয়ে স্মরণ রাখি।