ব্রাজিলের পতনের পেছনের কারণ কী? রোমারিওর মন্তব্যে উঠে এলো সত্য

বিশ্ব ফুটবলে ব্রাজিলের নাম যেন এক অনন্ত জাদুকরী গল্পের নাম। পেলে, গারিঞ্চা, জিকো, রোমারিও, রোনালদো, রোনালদিনহো, কাকা—প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ফুটবলকে প্রেমময় করে তুলেছে সেলেসাওরা। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্রাজিল ফুটবলে সেই জাদুর ছোঁয়া যেন ম্লান হতে শুরু করেছে। একের পর এক বড় টুর্নামেন্টে ব্যর্থতা, কোপা আমেরিকা ও বিশ্বকাপে প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থতা ফুটবলপ্রেমীদের মনে প্রশ্ন তুলেছে—কী হলো ব্রাজিলের?’

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে এবার মুখ খুললেন ব্রাজিলের কিংবদন্তি স্ট্রাইকার এবং ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপজয়ী নায়ক রোমারিও। তার মন্তব্যে উঠে এসেছে ব্রাজিল ফুটবলের ভেতরের গভীর সমস্যা এবং বাস্তবতা।

ব্রাজিল ফুটবলের ইতিহাস ও গৌরব

পাঁচবারের বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিল বিশ্বের একমাত্র দেশ, যারা সব কটি বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছে। ফুটবলে তাদের ছন্দ, কৌশল এবং সৌন্দর্য পৃথিবীজুড়ে ফুটবলকে জনপ্রিয় করেছে। “জোগো বনিতো”—অর্থাৎ সুন্দর খেলা—এই দর্শনের প্রবর্তক ছিল ব্রাজিল।

১৯৫৮ থেকে ২০০2 সাল পর্যন্ত ব্রাজিল চারটি বিশ্বকাপ জেতে। তবে এরপর থেকে, বিশেষ করে ২০১৪ সালে নিজ দেশে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে জার্মানির কাছে ৭-১ গোলে লজ্জাজনক হারের পর, তাদের পতন যেন আরও স্পষ্ট হতে শুরু করে।

সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স ও সংকট

  • ২০১4 বিশ্বকাপ: সেমিফাইনালে জার্মানির কাছে ৭-১ ব্যবধানে হার।
  • ২০১৮ বিশ্বকাপ: কোয়ার্টার ফাইনালে বেলজিয়ামের কাছে পরাজয়।
  • ২০২১ কোপা আমেরিকা: নিজ মাঠে আর্জেন্টিনার কাছে ফাইনালে হার।
  • ২০২২ বিশ্বকাপ: কোয়ার্টার ফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার কাছে টাইব্রেকারে পরাজয়।

এসব ব্যর্থতা ফুটবলবিশ্বকে হতাশ করেছে। প্রশ্ন উঠেছে—কোথায় সেই পুরনো ব্রাজিল?’

রোমারিওর মন্তব্য: কী বললেন কিংবদন্তি?

সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে রোমারিও ব্রাজিল ফুটবলের পতন সম্পর্কে খোলামেলা মন্তব্য করেন। তার কথাগুলো ছিল নির্লিপ্ত, বাস্তব এবং খানিকটা বেদনাদায়কও।

রোমারিওর মূল বক্তব্য:

১. ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা: রোমারিও বলেন, “আজকের ব্রাজিল ফুটবল পরিচালনা করছে এমন লোকেরা, যারা নিজেরাই ফুটবল বোঝে না। তারা অর্থ ও স্বার্থের পেছনে ছুটছে, খেলোয়াড় উন্নয়নের চেয়ে ব্যবসায়িক লাভকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।”

২. ট্যালেন্টের অভাব নয়, সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব: “ট্যালেন্ট এখনও আছে,” বলেন রোমারিও। “কিন্তু সেই ট্যালেন্টকে পরিপূর্ণ খেলোয়াড়ে পরিণত করার জন্য যে প্রশিক্ষণ ও দিকনির্দেশনা দরকার, তা অনুপস্থিত।”

৩. প্রচণ্ড আন্তর্জাতিক চাপ: রোমারিও মনে করেন, ব্রাজিলের খেলোয়াড়রা আজ আন্তর্জাতিক ক্লাব ফুটবলের কারণে খুব অল্প বয়সেই ইউরোপে চলে যাচ্ছে। সেখানে তারা অর্থের পেছনে ছুটছে, জাতীয় দায়িত্বের চেয়ে ক্লাবের স্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছে।

৪. কোচিং কৌশলের দুর্বলতা: তিনি উল্লেখ করেন, “ব্রাজিল এখন আর সেই পুরনো কৌশল অনুসরণ করে না। আমরা নিজেদের শক্তি ভুলে অন্য দেশের স্টাইল অনুকরণ করতে গিয়ে নিজেদের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলেছি।”

বিশ্লেষণ: রোমারিওর মন্তব্য কতটা বাস্তবসম্মত?

রোমারিওর বক্তব্য নতুন কিছু নয়, তবে যখন একজন বিশ্বকাপজয়ী নায়ক এভাবে সরাসরি অভিযোগ তোলেন, তখন তা গুরুত্ব পাওয়া স্বাভাবিক। বর্তমান ব্রাজিল ফুটবলের দিকে তাকালে দেখা যায়:

  • টেকনিক্যাল ডিরেক্টরদের ব্যর্থতা: সঠিক প্রোগ্রাম ও লং-টার্ম পরিকল্পনার অভাব।
  • ক্লাব ফুটবলে বেশি মনোযোগ: অনেক তরুণ খেলোয়াড় ইউরোপীয় ক্লাবে যোগ দিয়ে দ্রুত আর্থিক সাফল্য পেলেও জাতীয় দলের প্রতি অনুরাগ হারাচ্ছে।
  • কৌশলগত বিভ্রান্তি: ব্রাজিলের নিজস্ব “জোগো বনিতো” স্টাইল থেকে সরে গিয়ে তারা ইউরোপীয় রক্ষণাত্মক ফুটবলের ধাঁচ অনুকরণ করতে শুরু করেছে।
  • ম্যানেজমেন্টে দুর্নীতি: কনফেডারেশন অব ব্রাজিলিয়ান ফুটবল (CBF) নিয়ে বহুবার দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, যা খেলোয়াড় উন্নয়ন ও ফুটবল প্রশাসনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

বর্তমান খেলোয়াড়দের মনোভাব ও বাস্তবতা

নেইমার, ভিনিসিয়াস জুনিয়র, রদ্রিগো, গ্যাব্রিয়েল জেসুসের মতো খেলোয়াড়রা একক দক্ষতায় দারুণ। কিন্তু রোমারিও যেটি বলছেন, সেটি হলো—দলীয় সংহতির অভাব। আগে ব্রাজিলের দলে ‘একটি স্বপ্ন’ দেখা যেত; আজ অনেক সময় তা ব্যক্তিগত সফলতার লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।

ভবিষ্যতের পথ: কী করতে হবে ব্রাজিলের?

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ব্রাজিল যদি তার ফুটবল ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে চায়, তাহলে:

  • স্থানীয় ফুটবল অবকাঠামো শক্তিশালী করতে হবে।
  • তারুণ্যের বিকাশে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
  • কৌশলে আবারআনন্দের ফুটবলফিরিয়ে আনতে হবে।
  • ফুটবল প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে।
  • জাতীয় দলে সম্মানের অনুভূতি ফিরিয়ে আনতে হবে।

রোমারিওও তার বক্তব্যে বলেছেন, “আমাদের প্রথম কাজ হলো ফুটবলে স্বচ্ছতা ফেরানো এবং ফুটবলকে আবার আনন্দের উৎসে পরিণত করা।”

উপসংহার

ব্রাজিল শুধু একটি ফুটবল দল নয়—একটি আবেগ, একটি সংস্কৃতি। রোমারিওর বক্তব্য মনে করিয়ে দেয়, কোনো জাতির ফুটবল গৌরব শুধু প্রতিভা বা ট্রফিতে নয়, ফুটবল দর্শনে নিহিত। ব্রাজিল যদি আবার বিশ্বকে মন্ত্রমুগ্ধ করতে চায়, তবে তাদের নিজেদের শিকড়ে ফিরে যেতে হবে—’জোগো বনিতো’-এর ছায়ায়। সমস্যা রয়েছে, তবে আশা এখনও মরে যায়নি। বিশ্ব ফুটবল এখনো অপেক্ষা করছে—আরেকবার সেই সত্যিকারের সেলেসাও জাদুর জন্য। রোমারিওর মতো কিংবদন্তিরা সেই নতুন ব্রাজিল দেখার আশায় পথ চেয়ে আছেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top