দৌলতদিয়ায় পদ্মা নদীতে ধরা পড়ল ২৮ কেজির কাতলা, বিক্রি অর্ধলক্ষাধিক টাকায়

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ঘাট এলাকায় পদ্মা নদীতে ধরা পড়েছে এক বিশাল আকৃতির কাতলা মাছ। মাছটির ওজন ২৮ কেজি এবং এটি বিক্রি হয়েছে ৫৫,০০০ টাকায়—যা এই অঞ্চলের সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম বৃহৎ কাতলা ধরা পড়ার ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। মাছটি শনিবার (৩ মে ২০২৫) ভোরে স্থানীয় জেলে মজনু সরদারের জালে ধরা পড়ে। মাছটি ধরা পড়ার পরপরই তা দৌলতদিয়া মাছঘাটে নিয়ে আসা হয়। বিশাল আকৃতির এই কাতলা মাছ দেখতে শত শত উৎসুক মানুষ জড়ো হন ঘাটে। অনেকেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মোবাইলে ছবি ও ভিডিও ধারণ করেন।

ঘটনার বিবরণ: নদী থেকে বাজার পর্যন্ত

স্থানীয় জেলে মজনু সরদার জানান, শনিবার ভোরে তিনি প্রতিদিনের মতো পদ্মায় মাছ ধরতে যান। রাতভর পানি কমে আসায় তিনি ভেবেছিলেন বড় কিছু ধরা পড়বে। সকাল ৫টার দিকে হঠাৎ করে তাঁর পেতে রাখা বড় ফাঁদের জালে প্রচণ্ড ধাক্কা অনুভব করেন। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন, বড় কোনো পাঙাশ বা রুই হবে। পরে জালের টান দেখে বুঝতে পারেন এটি সাধারণ মাছ নয়।

জাল টেনে যখন মাছটি উপরে তোলা হয়, তখন উপস্থিত সহযাত্রী জেলেরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান। মাছটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৪ ফুট এবং প্রস্থ প্রায় দেড় ফুট। এমন বিশাল আকারের কাতলা মাছ সাম্প্রতিক সময়ে এই অঞ্চলে খুব কমই দেখা গেছে। মাছটি পরে ছোট একটি নৌকায় করে দৌলতদিয়া মাছঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে শুরু হয় দরকষাকষি। একপর্যায়ে রাজবাড়ী শহর থেকে আসা একজন পাইকার মাছটি ৫৫,০০০ টাকায় কিনে নেন।

মাছঘাটে উৎসবমুখর পরিবেশ

ঘটনার পরপরই দৌলতদিয়া মাছঘাটে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই খবর ছড়িয়ে পড়ে “বিশাল কাতলা ধরা পড়েছে!” আশপাশের এলাকা থেকে মানুষ ছুটে আসে মাছটি একনজর দেখতে। স্থানীয় একজন দোকানি বলেন, “এমন বিশাল কাতলা জীবনে একবারই দেখা হয়। পদ্মার কাতলা সব সময়ই বিখ্যাত, কিন্তু এত বড়টা বহু বছর পর দেখলাম।” দৌলতদিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাজী রফিকুল ইসলাম বলেন, “এ ধরনের মাছ এই এলাকার সম্পদ। এটি আমাদের নদীর স্বাস্থ্য এবং জীববৈচিত্র্যের এক অনন্য নিদর্শন।”

কাতলা মাছের বৈজ্ঞানিক পরিচিতি অর্থনৈতিক গুরুত্ব

কাতলা (Catla catla) দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় দেশীয় মাছ। এটি বিশেষভাবে পদ্মা, যমুনা, মেঘনা এবং গঙ্গা নদীতে প্রচুর পাওয়া যায়। কাতলা মাছ সাধারণত ওপেন ওয়াটার ফিশ, যারা নদীর গভীর অংশে ঘোরাফেরা করে। এদের ওজন ১৫–২০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে, তবে ২৫ কেজির বেশি ওজনের কাতলা এখন বিরল।

বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি সুস্থ নদী ব্যবস্থাপনা এবং পরিপূর্ণ খাদ্যচক্র থাকলেই কাতলা এভাবে বেড়ে উঠতে পারে। এই মাছ শুধু খাদ্য নয়, বরং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণেরও একটি প্রতীক। রাজবাড়ী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবুল কাসেম বলেন, “এটি অত্যন্ত ইতিবাচক একটি দৃষ্টান্ত। পদ্মার স্বাভাবিক পরিবেশ এখনো অনেকাংশে টিকে আছে বলেই এমন বড় আকারের মাছ ধরা পড়ছে। তবে এটি আমাদের কাছে একটি সতর্কবার্তাও—এই পরিবেশ টিকিয়ে রাখার জন্য এখনই কার্যকর উদ্যোগ দরকার।”

বাজার বিশ্লেষণ: দাম অর্ধলক্ষাধিক কেন?

মাছটির দাম নিয়ে কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন তুলেছেন “২৮ কেজির কাতলা ৫৫,০০০ টাকা? এত দাম কেমন করে হলো?”

এই বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় পাইকার হাবিবুর রহমান বলেন, “পদ্মার কাতলার চাহিদা বরাবরই বেশি। এই আকারের মাছ একদিকে যেমন সুস্বাদু, অন্যদিকে সামাজিক মর্যাদার প্রতীক হিসেবেও অনেকে কিনে থাকেন। এই মাছটি আমরা ঢাকায় এক রেস্টুরেন্টে সরবরাহ করব, যেখানে গ্রাহকেরা কেজিপ্রতি ২,৫০০ টাকা পর্যন্ত দিতে রাজি।” তথ্য অনুযায়ী, মাছটির কেজিপ্রতি বিক্রি হয়েছে প্রায় ১,৯৬৫ টাকায়—যা নদীর তাজা মাছের জন্য তুলনামূলকভাবে গ্রহণযোগ্য।

স্থানীয় অর্থনীতি জেলেদের আশা

এ ধরনের মাছ ধরা পড়া শুধু সৌভাগ্যের ব্যাপার নয়, বরং তা স্থানীয় অর্থনীতিতেও তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলে। স্থানীয় অনেক জেলেই বলেন, এখনকার দিনে বড় মাছ পাওয়া কষ্টকর। তবে মাঝে মাঝে এমন বিশাল মাছ ধরা পড়লে জেলেদের মধ্যে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়। জেলে মজনু সরদার বলেন, “এই মাছটা পেয়ে আমার ছেলেমেয়েদের জন্য স্কুলের বাকি ফিস মিটিয়ে দিতে পারব। এমন মাছ রোজ রোজ ধরা পড়ে না, কিন্তু এটুকু অন্তত বুঝতে পারি—পদ্মা আমাদের এখনো কিছু দিচ্ছে।”

নদী দূষণ চ্যালেঞ্জ

যদিও এই ধরণের মাছ ধরা আমাদের উৎসাহিত করে, বাস্তবতা হলো পদ্মার স্বাস্থ্য দিনে দিনে হুমকির মুখে পড়ছে। নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়া, বালু উত্তোলন, শিল্পবর্জ্য ফেলা এবং জলজ সম্পদের অনিয়ন্ত্রিত আহরণের কারণে বড় মাছ ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। নদী গবেষক অধ্যাপক কামরুল হাসান বলেন, “২০ বছর আগেও এমন বিশাল মাছ হরহামেশাই পাওয়া যেত। এখন বছরে কয়েকটি মাত্র ধরা পড়ে। এটি প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারানোর ইঙ্গিত। তাই সময় থাকতেই পদ্মাকে বাঁচাতে হবে।”

সংরক্ষণের আহ্বান

স্থানীয় প্রশাসন এবং পরিবেশবাদীরা মনে করেন, মাছের প্রজনন মৌসুমে কারেন্ট জাল বন্ধ, মাছের চলাচলের জন্য বাধাহীন নদীপ্রবাহ নিশ্চিতকরণ এবং নদী দূষণ নিয়ন্ত্রণ ছাড়া ভবিষ্যতে এমন মাছ পাওয়া ক্রমেই অসম্ভব হয়ে উঠবে। রাজবাড়ী জেলা প্রশাসক বলেন, “আমরা চেষ্টা করছি জেলেদের সচেতন করতে, প্রজনন মৌসুমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে অভিযান চালাতে। তবে শুধু প্রশাসন নয়, সাধারণ জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে।”

উপসংহার: পদ্মার উপহার, কিন্তু কতদিন চলবে?

দৌলতদিয়ার পদ্মা নদী শনিবার সকালে উপহার দিয়েছে একটি চমকপ্রদ প্রাকৃতিক দান ২৮ কেজির কাতলা মাছ। এটি শুধু একটি মাছ নয়, এটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জীববৈচিত্র্য এবং মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িত এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে এই রকম ঘটনা কেবল স্মরণীয় করে রাখলে হবে না; আমাদের কাজ করতে হবে যেন ভবিষ্যতেও পদ্মা তার বুকভরা প্রাণের ঝলক দেখাতে পারে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top