
বাংলাদেশ ক্রিকেটে আবারও নেতৃত্বে পরিবর্তন এসেছে। চলমান সময়ের বাস্তবতা এবং ভবিষ্যতের লক্ষ্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) টি–টোয়েন্টি দলের অধিনায়ক হিসেবে লিটন দাসকে এবং সহ–অধিনায়ক হিসেবে মেহেদী হাসান মিরাজকে নিয়োগ দিয়েছে। এই সিদ্ধান্তটি বাংলাদেশের ক্রিকেট অঙ্গনে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। একদিকে অভিজ্ঞতা, অন্যদিকে তরুণ নেতৃত্বগুণ এই দুইয়ের সমন্বয়েই গঠিত হয়েছে বাংলাদেশের টি–টোয়েন্টি দলের নতুন নেতৃত্ব প্যানেল।
নেতৃত্ব পরিবর্তনের পেছনের প্রেক্ষাপট
টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ঠিক আগমুহূর্তে নেতৃত্বে এই পরিবর্তন বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সদ্যসমাপ্ত কিছু সিরিজে দলের পারফরম্যান্স ছিল মিশ্র। অধিনায়কত্ব নিয়ে মাঠের ভেতর–বাইরের নানা আলোচনা চলছিল দীর্ঘদিন ধরেই। সাকিব আল হাসান, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মুশফিকুর রহিমের মতো অভিজ্ঞ ক্রিকেটাররা এই ফরম্যাট থেকে একে একে সরে দাঁড়িয়েছেন বা বিরতি নিয়েছেন। সেই প্রেক্ষাপটে তরুণ মুখদের দায়িত্ব দিয়ে ভবিষ্যতের দিকে এগোনোর পরিকল্পনাই ছিল বোর্ডের। বিশেষজ্ঞদের মতে, “বিসিবি এখন ভবিষ্যত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দীর্ঘমেয়াদি নেতৃত্ব গড়ে তুলতে চায়। লিটন-মেহেদী যুগের সূচনা তাই সময়োচিত সিদ্ধান্ত।”
কেন লিটন দাস?
লিটন দাস শুধু ব্যাটসম্যান হিসেবেই নয়, একজন নেতৃত্বদানে সক্ষম ক্রিকেটার হিসেবেও নিজেকে প্রমাণ করেছেন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। তিনি দেশের হয়ে প্রায় সব ফরম্যাটেই খেলেছেন এবং সময়োপযোগী পারফরম্যান্স করেছেন। গত কয়েক বছর ধরেই জাতীয় দলের সহ–অধিনায়কত্ব করেছেন এবং একাধিক ম্যাচে অধিনায়কত্ব করতেও দেখা গেছে তাঁকে।
লিটনের ব্যাটিং স্টাইল আক্রমণাত্মক হলেও তার মধ্যে রয়েছে ধৈর্য ও পরিকল্পনার ছাপ। ২০২২ সালে ভারতের বিপক্ষে তার ঐতিহাসিক ইনিংস কিংবা নিউজিল্যান্ডের মাটিতে তার ধারাবাহিকতা—সবই তার মানসিক দৃঢ়তা ও ম্যাচ রিডিং স্কিলের প্রমাণ। বোর্ড মনে করে, টি–টোয়েন্টি ফরম্যাটে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা, বোলার ব্যবহারে বিচক্ষণতা এবং মিডল-অর্ডারে নেতৃত্ব দেওয়ার উপযুক্ত গুণাবলি রয়েছে লিটনের মধ্যে। এক বোর্ড কর্মকর্তা বলেন, “লিটন এখন পরিণত এক ক্রিকেটার। তার হাতে ভবিষ্যতের নেতৃত্ব তুলে দিলে বাংলাদেশ টি–টোয়েন্টি ক্রিকেটের জন্য এটি ভালো সিদ্ধান্ত হবে বলেই মনে করি।”
সহ–অধিনায়ক হিসেবে মেহেদী হাসান মিরাজ
অন্যদিকে, তরুণ কিন্তু অভিজ্ঞ অলরাউন্ডার মেহেদী হাসান মিরাজকেও উপযুক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সহ–অধিনায়কের। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের পর থেকেই তিনি ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করে যাচ্ছেন। তার কাঁধে যেমন বোলিংয়ের দায়িত্ব থাকে, তেমনি ব্যাট হাতে একাধিক ম্যাচ জিতিয়ে দেওয়ার ইতিহাসও রয়েছে।
বিশেষত গত এক–দু’বছরে তাঁর ব্যাটিং দক্ষতা যেভাবে উন্নত হয়েছে, তাতে বোঝা যায় যে তিনি একজন পরিপূর্ণ ক্রিকেটারে পরিণত হচ্ছেন। শুধু পারফরম্যান্স নয়, দলের ভেতরে মিরাজের উপস্থিতি এবং ইতিবাচক মানসিকতা অনেকের জন্যই অনুপ্রেরণাদায়ক। টিমমেটদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো, মাঠে চিৎকার না করে শান্তভাবে নেতৃত্ব দেওয়ার গুণও রয়েছে তার মধ্যে। লিটনের সঙ্গে তার বোঝাপড়া অনেক পুরনো। দু’জনেই সিলেট এবং জাতীয় দলের হয়ে অনেক ম্যাচ খেলেছেন। সেই বোঝাপড়া মাঠেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে।
অধিনায়কত্বে চ্যালেঞ্জ
নতুন নেতৃত্বের জন্য চ্যালেঞ্জ কম নয়। ২০২৪–২৫ মৌসুমে বাংলাদেশকে খেলতে হবে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, এশিয়া কাপ এবং একাধিক দ্বিপাক্ষিক সিরিজ। দলের বর্তমান স্কোয়াডে যেমন তরুণ ক্রিকেটার বেশি, তেমনি সিনিয়রদের অনুপস্থিতিও স্পষ্ট। লিটন ও মেহেদীকে তাই মাঠের মধ্যে শুধু পারফর্ম করলেই চলবে না, মাঠের বাইরে থেকেও দলকে উজ্জীবিত রাখতে হবে।
বিশেষ করে চাপের সময়ে ট্যাকটিক্স নির্বাচন, বোলারদের পরিবর্তন, ফিল্ডিং সাজানো কিংবা রান তাড়ায় পরিকল্পনা এই সবকিছুতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে দ্রুত এবং সঠিকভাবে। এ ছাড়া মিডিয়া হ্যান্ডলিং, ড্রেসিংরুম কৌশল, প্লেয়ার ম্যানেজমেন্ট এসবও অধিনায়কের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মোর্ত্তজা বলেন, “লিটন যদি নিজের মতো করে অধিনায়কত্ব করতে পারে, দল তার নেতৃত্বে ভালো করবে। তাকে নিজের সিদ্ধান্তে বিশ্বাস রাখতে হবে।”
খেলোয়াড়দের প্রতিক্রিয়া
নতুন নেতৃত্ব নিয়ে দলের অন্যান্য খেলোয়াড়দের প্রতিক্রিয়াও ইতিবাচক। এক সিনিয়র ক্রিকেটার বলেন, “লিটন খুবই কুল–হেডেড। সে কাউকে ছোট করে না। আমরা মনে করি, ওর নেতৃত্বে ড্রেসিংরুমের পরিবেশ আরও ভালো হবে।” আরেক তরুণ ক্রিকেটার বলেন, “মিরাজ ভাই আমাদের খুব হেল্প করেন। ওনার মতো মানুষ যদি সহ–অধিনায়ক হন, তাহলে জুনিয়ররা সহজেই কথা বলতে পারবে।”
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
বাংলাদেশ ক্রিকেটে নেতৃত্ব বদল মানেই শুধু দায়িত্বের পরিবর্তন নয়, তা ভবিষ্যতের পরিকল্পনারও প্রতিফলন। বিসিবি এবার পরিকল্পনা করছে দীর্ঘমেয়াদি নেতৃত্বের। যেমনটি করেছিল ইংল্যান্ড তাদের বাটলার–মরগান যুগে কিংবা ভারত রোহিত–পান্ডিয়া যুগে। বিশ্ব ক্রিকেটে আজকাল টি–টোয়েন্টি দলগুলোর আলাদা সেটআপ গঠন হচ্ছে। বাংলাদেশও সেই পথেই হাঁটছে। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে অনেকেই জাতীয় দলে আসছে। লিটন ও মেহেদীর নেতৃত্বে সেই তরুণ দলকে কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে পারলেই আগামী পাঁচ বছরেও বাংলাদেশ টি–টোয়েন্টি দলে স্থিতিশীলতা আসবে।
কোচিং স্টাফ ও বোর্ডের সমর্থন
বোর্ড প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান পাপন বলেছেন, “আমরা লিটনকে সময় দিতে চাই। ওর মধ্যে নেতৃত্বের গুণ আছে। একইসঙ্গে আমরা মিরাজকেও প্রস্তুত করছি ভবিষ্যতের জন্য।” নতুন কোচিং স্টাফ, বিশেষ করে ব্যাটিং ও ফিল্ডিং কোচ, লিটন–মেহেদীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছেন। তাদের লক্ষ্য, নেতৃত্বের ভারে যেন পারফরম্যান্সে প্রভাব না পড়ে, বরং আরও বাড়ে।
সমাপ্তি
নতুন নেতৃত্ব মানেই নতুন আশা, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। টি–টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সাফল্য খুব বেশি নয়। তবে এই পরিবর্তন যদি সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়, তাহলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের টি–টোয়েন্টি দল আরও ধারালো, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং জয়ের ধারায় ফিরতে পারবে।
লিটন মেহেদীর যুগ এখন শুরু। মাঠ বলবে, এই যুগ কতটা সফল হয়। তবে একথা নিশ্চিত করে বলা যায় তাদের ওপর প্রত্যাশার ভার অনেক, এবং সামনে যাত্রা সহজ হবে না। কিন্তু দায়িত্ব এবং সম্ভাবনার ভারসাম্য যদি ঠিকভাবে সামলাতে পারেন, তবে আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের টি–টোয়েন্টি ক্রিকেটে আসতে পারে এক নতুন সুবাস।