গাজায় অভিযান জোরদার: ইসরায়েলের সেনা তলবের নির্দেশ

মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার পারদ আবারও ঊর্ধ্বমুখী। গাজা উপত্যকায় অভিযান জোরদার করতে যাচ্ছে ইসরায়েল। এই অভিযানের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (IDF) কয়েক হাজার সংরক্ষিত (রিজার্ভ) সেনা সদস্যকে তলব করেছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট এই নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানিয়েছে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। এই পদক্ষেপ ইঙ্গিত দিচ্ছে, গাজায় চলমান সামরিক তৎপরতা আরও বিস্তৃত এবং দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। এছাড়াও, সাম্প্রতিক হামাস বিরোধী অভিযানে বাড়তি সেনা প্রয়োজন দেখা দেয়ায় এই রিজার্ভ সেনা তলব করা হয়েছে বলে সামরিক সূত্র জানায়।

অভিযানের পটভূমি

২০২৩ সালের অক্টোবরের সংঘাতের পর থেকে ইসরায়েল গাজায় বারবার সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছে। তবে ২০২৫ সালের শুরুতে সংঘাত আবারও ভয়াবহ রূপ নেয়, যখন হামাসের রকেট হামলার জবাবে ইসরায়েল স্থল ও আকাশপথে পাল্টা হামলা শুরু করে। প্রায় ছয় মাস ধরে চলা সংঘাতে গাজা অঞ্চলের বহু অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে। হাজার হাজার সাধারণ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, লাখো মানুষ ঘরছাড়া হয়েছেন। আন্তর্জাতিক মহলের নিন্দা এবং যুদ্ধবিরতির আহ্বান সত্ত্বেও সংঘাত থামার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

রিজার্ভ সেনা তলব: কী বলছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়?

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, “গাজায় জঙ্গিগোষ্ঠী নির্মূলে সেনা অভিযানের অংশ হিসেবে কয়েক হাজার সংরক্ষিত সেনাকে সক্রিয় করা হচ্ছে। এরা আগামী কয়েকদিনের মধ্যে মোতায়েন করা হবে দক্ষিণাঞ্চলীয় ফ্রন্টে।” প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট বলেন, “গাজায় আমাদের কাজ শেষ হয়নি। আমরা হামাসের সামরিক অবকাঠামো ধ্বংস করবো, তাদের নেতৃত্ব নির্মূল করবো। যতদিন প্রয়োজন, ততদিন অভিযান চলবে।” তিনি আরও জানান, রিজার্ভ বাহিনীর সদস্যরা ইতোমধ্যেই সমাবেশকেন্দ্রে উপস্থিত হতে শুরু করেছেন এবং তাদেরকে ‘বিশেষ অভিযান’ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।

গাজা পরিস্থিতি: মানবিক সংকট চরমে

জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, গাজা উপত্যকায় এখন ভয়াবহ মানবিক সংকট বিরাজ করছে।

  • প্রায় ২.৩ মিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত।
  • খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানির সংকট চরমে।
  • অধিকাংশ হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে গেছে।
  • শিশু ও বৃদ্ধদের মধ্যে অপুষ্টি এবং সংক্রমণ ব্যাপক হারে ছড়াচ্ছে।

রেডক্রস, ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম (WFP) এবং ডব্লিউএইচও’র পক্ষ থেকে ইসরায়েলকে বারবার আহ্বান জানানো হয়েছে যেন তারা মানবিক করিডোর চালু করে এবং যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে।

হামাসের প্রতিক্রিয়া

হামাসের এক মুখপাত্র কাতারভিত্তিক আল-জাজিরা টেলিভিশনে বলেন, “ইসরায়েল এক তরফা আগ্রাসনের মাধ্যমে গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে। তারা যতোই সেনা পাঠাক, ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ থেমে থাকবে না।” হামাস দাবি করেছে, তাদের যোদ্ধারা এখনো দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস, রাফাহ এবং কিছু মধ্যাঞ্চলে সক্রিয় রয়েছে এবং তারা “উপযুক্ত সময়ে” পাল্টা হামলার জন্য প্রস্তুত।

রাফাহ সীমান্তে বড় ধরণের অভিযান আশঙ্কা

বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েলের সেনা সমাবেশ মূলত রাফাহ সীমান্তকে কেন্দ্র করে। কারণ এটি গাজা ও মিশরের সংযোগস্থল এবং মানবিক সহায়তার মূল প্রবেশপথ। ইসরায়েল দাবি করছে, এই সীমান্ত দিয়েই অস্ত্র পাচার ও হামাস যোদ্ধাদের গোপন চলাচল হয়। তাই তারা এখানে “নির্বিচারে অভিযান” নয়, বরং “টার্গেটেড অ্যাকশন” করতে চায়। তবে মানবিক সংস্থাগুলোর আশঙ্কা, রাফাহতে সামরিক অভিযান চালালে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

মার্কিন প্রতিক্রিয়া: মিশ্র বার্তা

যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রধান মিত্র হিসেবে সব সময়ই তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে সমর্থন জানিয়ে আসছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ের মানবিক সংকট এবং বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় বাইডেন প্রশাসন চাপের মুখে পড়েছে।

হোয়াইট হাউস থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “আমরা গাজায় মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করতে চাই। একই সঙ্গে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারকে স্বীকৃতি দিই। তবে আমরা আশা করি, বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে অভিযান চালানো হবে।” সংশ্লিষ্ট কূটনৈতিক সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্র রাফাহ অভিযানে ‘সতর্কতা’ অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছে। তবে কোনো সামরিক সহায়তা বন্ধের ইঙ্গিত মেলেনি।

ইসরায়েলি জনগণের প্রতিক্রিয়া

ইসরায়েলের অভ্যন্তরে এই দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতকে ঘিরে জনমত বিভক্ত হয়ে পড়েছে। অনেকে এই অভিযানকে “আত্মরক্ষার জরুরি পদক্ষেপ” মনে করলেও, একটি বড় অংশ বলছে “এতে শুধু নিরীহ মানুষ মরছে, আর আমাদের সেনারা হতাহত হচ্ছে।” তেলআবিব ও হাইফায় শান্তি আন্দোলনের কর্মীরা রাজপথে নেমে যুদ্ধবিরতির দাবি জানিয়েছেন। তাদের হাতে প্ল্যাকার্ড “Enough Bloodshed”, “Stop the Siege”, “Let Gaza Live”

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

  • জাতিসংঘ যুদ্ধবিরতি এবং মানবিক সহায়তা প্রবেশের অনুমতির জন্য আহ্বান জানিয়েছে।
  • ইইউ গাজায় চলমান সংঘাতে ‘মাত্রাতিরিক্ত সহিংসতা’র কথা বলেছে।
  • তুরস্ক, কাতার, ইরান—ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় বিবৃতি দিয়েছে।
  • মিশর রাফাহ সীমান্তে সামরিক অভিযান বন্ধে কূটনৈতিক চেষ্টায় নিয়োজিত।

বিশ্লেষণ: নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করছে গাজা যুদ্ধ

বিশ্লেষকদের মতে, গাজা যুদ্ধ এখন এমন এক মোড়ে পৌঁছেছে যেখানে দ্রুত কোনো সমাধান বা যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। ইসরায়েলের রিজার্ভ সেনা তলব এবং হামাসের সক্রিয় প্রতিরোধ ইঙ্গিত দিচ্ছে, সংঘাত আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে। মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক ড. সাইমন হার্স বলছেন, “ইসরায়েল মনে করছে, সম্পূর্ণ সামরিক বিজয় অর্জন ছাড়া হামাসকে ঠেকানো সম্ভব নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, গাজা একটি জনবহুল এলাকা। সশস্ত্র যুদ্ধ সেখানে প্রতিদিন শুধু নতুন সংকট সৃষ্টি করছে।”

উপসংহার

গাজা উপত্যকায় আবারও বড়সড় রক্তক্ষয়ী অধ্যায়ের শুরু হতে চলেছে। ইসরায়েলের সেনা সমাবেশ এবং অভিযান সম্প্রসারণের ইঙ্গিত স্পষ্টতই আরও মৃত্যু, ধ্বংস এবং মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। অন্যদিকে, হামাস এবং ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গোষ্ঠী নিজেদের অস্তিত্বের লড়াই বলেই এই যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে। দুই পক্ষেরই আপোষহীন অবস্থান, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দুর্বল হস্তক্ষেপ সব মিলিয়ে পরিস্থিতি শান্তির চেয়ে সংঘাতময়ই হয়ে উঠছে।

প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে—এই যুদ্ধ কবে শেষ হবে? এবং কে দেবে গাজার শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ ভোর?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top