
গাজা ও পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য জাতিসংঘ পরিচালিত মানবিক ত্রাণ কার্যক্রমে ইসরায়েল বাধা সৃষ্টি করছে—এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) আনুষ্ঠানিক শুনানি শুরু হয়েছে। নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত এই আদালত বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলোর অন্যতম বড় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে এই মামলাটি গ্রহণ করেছে।
অভিযোগের পটভূমি
গত কয়েক মাস ধরে ফিলিস্তিনে চলমান সংঘাত পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা—বিশেষ করে UNRWA (United Nations Relief and Works Agency for Palestine Refugees)—ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনায় ব্যাপক বাধার সম্মুখীন হয়েছে। খাদ্য, পানি, চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং জরুরি আশ্রয় সামগ্রী সরবরাহের ক্ষেত্রে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ, চলাচলে বিধিনিষেধ এবং সরাসরি হামলার অভিযোগ উঠেছে।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী:
- অসংখ্য ত্রাণ সরবরাহকারী কনভয় আটকে দেওয়া হয়েছে বা গাজায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি।
- ত্রাণকর্মীরা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
- কয়েকটি ত্রাণকেন্দ্র লক্ষ্য করে হামলার ঘটনাও ঘটেছে, যেখানে সাধারণ জনগণ আশ্রয় নিয়েছিল।
এসব অভিযোগ আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, বিশেষ করে মানবিক আইনের (International Humanitarian Law) আওতায়।
আন্তর্জাতিক আইনের প্রাসঙ্গিকতা
আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অনুযায়ী, যুদ্ধাবস্থায় বেসামরিক জনগণের জন্য মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক।
বিশেষ করে:
- চতুর্থ জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী, অধিকৃত এলাকার অধিবাসীদের মানবিক সহায়তায় বাধা দেওয়া নিষিদ্ধ।
- মানবাধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুসারে, সকল মানুষের খাদ্য, পানি এবং চিকিৎসার ন্যূনতম চাহিদা মেটানোর অধিকার রয়েছে।
এই আইনি নীতিমালার আলোকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারিক মূল্যায়নের আওতায় এসেছে।
শুনানির অগ্রগতি
প্রথম দিনের শুনানিতে:
- জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়।
- ত্রাণ সরবরাহে বাধা, সীমান্তে দীর্ঘসূত্রতা, এবং সংঘাত কবলিত অঞ্চলে নিরাপদ ত্রাণ বিতরণ ব্যাহত করার নির্দিষ্ট উদাহরণ আদালতে তুলে ধরা হয়।
- ইসরায়েলের প্রতিনিধিরা তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেন, নিরাপত্তার কারণেই কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। তারা ত্রাণ বিতরণ বন্ধ করার কোনো ইচ্ছাকৃত নীতি মেনে চলেনি বলে দাবি করে।
আদালত আগামী সপ্তাহজুড়ে আরও শুনানি গ্রহণ করবে এবং বিভিন্ন পক্ষের যুক্তি পর্যালোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণ করবে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার সংস্থা, ত্রাণ সংস্থা এবং কিছু রাষ্ট্র ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
বিশেষ করে:
- অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে।
- ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আরব লীগ, এবং বেশ কয়েকটি আফ্রিকান রাষ্ট্র জাতিসংঘের মানবিক তৎপরতায় বাধা দেওয়ার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে।
- সাধারণ মানুষের মধ্যে বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া ও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষার যুক্তি
ইসরায়েল আদালতে দাবি করেছে:
- গাজা অঞ্চলের সুনির্দিষ্ট এলাকায় হামাস বা অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ত্রাণের নামে অস্ত্র পাচার করছে।
- ত্রাণের মাধ্যমে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো নতুন করে সংঘাত পরিচালনার সুযোগ পায়।
- তাই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিয়ন্ত্রণ জরুরি ছিল।
তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, নিরাপত্তা নিশ্চিতে নেওয়া পদক্ষেপ কখনোই সাধারণ জনগণের মানবিক চাহিদা উপেক্ষা করার অজুহাত হতে পারে না।
সম্ভাব্য প্রভাব
আন্তর্জাতিক আদালতের এই শুনানি ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হতে পারে। যদি আদালত ইসরায়েলের বিরুদ্ধে রায় দেয়, তবে:
- ইসরায়েলকে ত্রাণ কার্যক্রমে বাধা না দিতে আদেশ দেওয়া হতে পারে।
- আর্থিক ক্ষতিপূরণ দাবি করা হতে পারে।
- ভবিষ্যতে মানবিক সহায়তার বাধা প্রদানের বিরুদ্ধে কঠিন আন্তর্জাতিক নীতিমালা গঠিত হতে পারে।
তবে আইসিজের রায় বাধ্যতামূলক হলেও, তা কার্যকর করতে সদস্য রাষ্ট্র ও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন হবে।
ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন:
- গাজা ও পশ্চিম তীরে চলমান মানবিক সংকট সমাধানে রাজনৈতিক সমাধান জরুরি।
- মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করা ছাড়া সেখানে স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনা সম্ভব নয়।
- আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে যেন মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের জবাবদিহির আওতায় আনা যায়।
উপসংহার
ফিলিস্তিনের মাটিতে যখন মানবিক সংকট গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে, তখন জাতিসংঘের ত্রাণকাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ আন্তর্জাতিক আইনের চোখে গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া এই শুনানি শুধু ফিলিস্তিনের মানুষের ভবিষ্যতের জন্য নয়, বরং বিশ্বব্যাপী মানবিক ন্যায়ের প্রশ্নেও এক মাইলফলক হয়ে দাঁড়াতে পারে।
বিশ্ব এখন তাকিয়ে রয়েছে হেগের আদালতের দিকে—এই শুনানি শেষ পর্যন্ত মানবতার পক্ষে কতটা জোরালো বার্তা দিতে পারে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।