
দক্ষিণ এশিয়া দীর্ঘদিন ধরে ভারত ও পাকিস্তানকে কেন্দ্র করেই আলোচিত হয়ে এসেছে—রাজনীতি, অর্থনীতি কিংবা ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে তার নিজস্ব গতিতে অগ্রসর হচ্ছে, যা অনেক ক্ষেত্রেই ভারত ও পাকিস্তানকে ছাপিয়ে গেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক সূচক, নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্ষেত্রে অগ্রগতি এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার নতুন নেতৃত্বের সম্ভাব্য দাবিদার হিসেবে তুলে ধরেছে।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন:
বাংলাদেশের অর্থনীতি গত এক দশকে ব্যাপক রূপান্তর ঘটিয়েছে। ২০২০ সালেও যেখানে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বিশ্ব অর্থনীতি বিপর্যস্ত, সেখানে বাংলাদেশ ৫.২৪% জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। তৈরি পোশাক শিল্প, প্রবাসী আয় এবং কৃষি খাতের অগ্রগতিই এই প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি। বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। এই শিল্পে নারী শ্রমিকদের বিশাল অংশগ্রহণ অর্থনীতিতে নারীর সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করেছে। পাশাপাশি, দেশে রপ্তানি বহুমুখীকরণ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও বড় বিনিয়োগ দেখা যাচ্ছে। স্টার্টআপ সংস্কৃতি ও ডিজিটাল বাংলাদেশ কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রযুক্তি খাতেও বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অবস্থানে পৌঁছেছে।
সামাজিক অগ্রগতি ও মানব উন্নয়ন:
মানব উন্নয়ন সূচক (Human Development Index – HDI) অনুযায়ী, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে। শিশু মৃত্যু হার, মাতৃমৃত্যু হার, গড় আয়ু, এবং সাক্ষরতার হারসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের চেয়েও ভালো করছে। বিশ্ব ব্যাংক ও জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে শিশু ও মাতৃমৃত্যু হ্রাস পেয়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। গড় আয়ু বর্তমানে ৭২.৪ বছর, যা পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। সাক্ষরতার হারও বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিশেষত নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে, যেখানে বাংলাদেশ ব্যাপক অগ্রগতি দেখিয়েছে। স্কুলে ছেলেমেয়ের অনুপাত এখন প্রায় সমান।
নারীর ক্ষমতায়ন:
নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সফল দেশ হিসেবে বিবেচিত। প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, সংসদের স্পিকারসহ শীর্ষ রাজনৈতিক পদে নারীর উপস্থিতি ইতোমধ্যেই প্রমাণ করে দিয়েছে যে নারীরা বাংলাদেশে নেতৃত্ব দিতে পারছে। এছাড়া, পোশাক শিল্প, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, এবং প্রশাসনিক খাতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। নারী উদ্যোক্তা তৈরির জন্য বিভিন্ন ব্যাংকিং সুবিধা, প্রশিক্ষণ, এবং সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। গ্রামীণ পর্যায়ে মাইক্রোফাইন্যান্স ও এনজিও কার্যক্রম নারী উন্নয়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে।
শিক্ষা ও প্রযুক্তি:
“ডিজিটাল বাংলাদেশ” কর্মসূচির মাধ্যমে প্রযুক্তি ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। শিক্ষা খাতে ই-লার্নিং, মাল্টিমিডিয়া ক্লাস, এবং অনলাইন পরীক্ষা চালু হয়েছে। দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে, যা নাগরিকদের সরকারি সেবা প্রাপ্তি সহজ করেছে। প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে তরুণদের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। গার্মেন্টস খাতের বাইরে সফটওয়্যার রপ্তানি ও আউটসোর্সিং খাতেও বাংলাদেশ এখন উল্লেখযোগ্য অবস্থানে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সচেতনতা:
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা সত্ত্বেও পরিবেশ সংরক্ষণ ও অভিযোজন কার্যক্রমে বিশ্বে একটি উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করে নিজস্ব অর্থায়নে অভিযোজন কার্যক্রম পরিচালনা করছে, যা অনেক উন্নয়নশীল দেশের জন্য অনুকরণীয়।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও কূটনীতি:
বাংলাদেশ এখন আর কেবল দক্ষিণ এশিয়ার প্রান্তিক একটি রাষ্ট্র নয়, বরং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক কূটনীতিতে সক্রিয় এক অংশগ্রহণকারী। ভারতের সাথে তিস্তা চুক্তি, মিয়ানমারের সাথে রোহিঙ্গা সমস্যা, চীনের সাথে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব এবং পশ্চিমা বিশ্বের সাথে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রভিত্তিক সম্পর্ক বাংলাদেশের কূটনৈতিক পরিধিকে প্রসারিত করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে SAARC ও BIMSTEC এর মতো আঞ্চলিক সংস্থায় বাংলাদেশের নেতৃত্ব এবং সক্রিয়তা তাকে দক্ষিণ এশীয় কূটনীতির কেন্দ্রস্থলে এনে দাঁড় করিয়েছে। পাশাপাশি, UN Peacekeeping Operations-এ বাংলাদেশের অবদান আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্বীকৃত।
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা:
তবে এই অগ্রগতির পথ একেবারেই মসৃণ নয়। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, দুর্নীতি, জলবায়ু সংকট, এবং বৈষম্য এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষার গুণগত মান, স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, এবং নগরায়ণের সমস্যা সমাধানে আরো কার্যকর পরিকল্পনা প্রয়োজন। সরকারের রূপকল্প ২০৪১ এর লক্ষ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ একটি উচ্চ-মধ্যম আয়ের এবং জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হতে চায়। এই লক্ষ্যে পৌছাতে হলে সরকার, বেসরকারি খাত, এবং নাগরিক সমাজকে একত্রে কাজ করতে হবে।
উপসংহার:
দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ এখন আর কেবল উন্নয়নশীল একটি দেশ নয়, বরং সম্ভাবনার এক উজ্জ্বল প্রতীক। অর্থনীতি, শিক্ষা, নারী উন্নয়ন, এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দিক থেকে তার সাফল্য প্রমাণ করে যে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার নেতৃত্বে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য প্রস্তুত। যদিও এখনো বহু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবে সঠিক পরিকল্পনা ও কার্যকর বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ সত্যিই দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন নেতৃত্বের ভূমিকা নিতে পারবে।