
অ্যান্টিবায়োটিক এক সময় ছিল চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে বিশ্বজুড়ে অসংখ্য প্রাণ বেঁচে গেছে। তবে বর্তমানে অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা হুমকির মুখে পড়েছে। সাম্প্রতিক গবেষণা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) রিপোর্ট বলছে, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধক্ষমতা (Antimicrobial Resistance – AMR) এমন একটি স্তরে পৌঁছেছে যেখানে অনেক প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ আর কাজ করছে না। এটি শুধু স্বাস্থ্য খাতের জন্য নয়, বরং মানব সভ্যতার জন্য এক ভয়ংকর সংকেত।
অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের কারণ:
- অতিরিক্ত ও অযৌক্তিক ব্যবহার: অনেক ক্ষেত্রে ভাইরাসজনিত রোগে (যেখানে অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর নয়) চিকিৎসক বা রোগী নিজেরাই অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করেন।
- অপূর্ন ডোজ গ্রহণ: অনেকেই ওষুধ পুরো মেয়াদে না খেয়ে মাঝপথে বন্ধ করে দেন, ফলে জীবাণু আংশিকভাবে ধ্বংস হয় এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
- প্রাণী খাতে ব্যবহারে অব্যবস্থাপনা: পশু ও মুরগির খামারে দ্রুত বৃদ্ধির জন্য নির্বিচারে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়, যা মানবদেহেও প্রতিরোধ গড়তে সহায়ক হয়।
- ফার্মেসি থেকে সহজলভ্যতা: বাংলাদেশের মতো দেশে প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি হওয়াই এর বিস্তার ঘটাচ্ছে।
বর্তমান পরিস্থিতি:
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ৭ লাখ মানুষ অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সংক্রমণে মারা যায়। ২০৫০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা বছরে এক কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে বাংলাদেশে, পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছে কারণ এখানে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের উপর নিয়ন্ত্রণ খুবই দুর্বল।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট:
বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে নীতিমালা থাকলেও তার প্রয়োগ খুবই দুর্বল। জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (IEDCR) এবং DGHS-এর তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া অনেক রোগীই অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণুর সংক্রমণে আক্রান্ত। একটি উদ্বেগজনক দিক হলো, শিশুদের মধ্যে নিউমোনিয়া বা ডায়রিয়ার চিকিৎসায় ব্যবহৃত প্রথম সারির অ্যান্টিবায়োটিকগুলো আর আগের মতো কাজ করছে না। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে শেষ বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকও ব্যর্থ হচ্ছে।
স্বাস্থ্য খাতে প্রভাব:
- সাধারণ সংক্রমণ জটিল হচ্ছে: আগে যেসব সংক্রমণ সহজেই নিরাময়যোগ্য ছিল, এখন তা দীর্ঘস্থায়ী ও জটিল হয়ে উঠছে।
- সার্জারি ও ক্যানসার চিকিৎসা ঝুঁকিপূর্ণ: অস্ত্রোপচারের পর সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন, কিন্তু তা কাজ না করায় ঝুঁকি বাড়ছে।
- চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধি: অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধে চিকিৎসা দীর্ঘায়িত হয়, রোগীর হাসপাতাল খরচ ও ওষুধ ব্যয় বেড়ে যায়।
সম্ভাব্য সমাধান:
- সচেতনতা বৃদ্ধি: সাধারণ জনগণ ও চিকিৎসকদের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের সঠিক পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ ও প্রচার চালাতে হবে।
- নীতিমালা কার্যকর করা: প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি বন্ধ করতে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে।
- গবেষণায় বিনিয়োগ: নতুন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক এবং বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি উদ্ভাবনে গবেষণা বাড়াতে হবে।
- প্রাণী খাতে নিয়ন্ত্রণ: পশুপালন ও মৎস্য খাতে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে।
আন্তর্জাতিক উদ্যোগ:
WHO, FAO ও OIE মিলে “One Health” অ্যাপ্রোচের মাধ্যমে স্বাস্থ্য, প্রাণি ও পরিবেশ খাতের সমন্বয়ে কাজ করছে। বাংলাদেশও এই উদ্যোগের অংশ, তবে বাস্তবায়ন অনেকাংশে ধীরগতির।
উপসংহার:
অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ হচ্ছে এক নীরব মহামারি, যার প্রভাব আমরা প্রতিদিন আরও স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি। এখনই পদক্ষেপ না নিলে অচিরেই এমন এক বাস্তবতায় পৌঁছাবো যেখানে সাধারণ ইনফেকশনও মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠবে। সময় এসেছে চিকিৎসা খাত, নীতিনির্ধারক, এবং সাধারণ জনগণের একসাথে কাজ করার—অন্যথায় অ্যান্টিবায়োটিক-পরবর্তী যুগ আমাদের জন্য ভয়ংকর ভবিষ্যৎ বয়ে আনবে।