সাকিবকে সতর্ক করেছিলাম, আওয়ামীলীগে যেও না: মেজর হাফিজের বিস্ফোরক মন্তব্য

বাংলাদেশের ক্রিকেট তারকা ও সংসদ সদস্য সাকিব আল হাসানকে নিয়ে আবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছেন বিএনপি নেতা এবং অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ। সম্প্রতি একটি অনলাইন টকশোতে তিনি দাবি করেন, “সাকিবকে আমি ব্যক্তিগতভাবে বলেছিলাম—যা ইচ্ছা করো, আওয়ামী লীগে যেও না।”

এই মন্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে রাজনৈতিক মহল, এমনকি ক্রীড়াঙ্গনেও আলোড়ন তুলেছে। অনেকেই মনে করছেন, এটি শুধুই একটি মতামত নয়, বরং একটি দীর্ঘদিনের অভ্যন্তরীণ সংলাপের বহিঃপ্রকাশ। প্রতিবেদনটিতে আমরা বিশ্লেষণ করব এই বক্তব্যের পটভূমি, প্রতিক্রিয়া, সাকিবের রাজনৈতিক যাত্রা, এবং এর সম্ভাব্য প্রভাব।

প্রথমে যা ঘটেছে: একটি কথোপকথন ঘিরে বিতর্ক

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ একটি ইউটিউব চ্যানেলের সাক্ষাৎকারে বলেন:

“সাকিবকে আমি একাধিকবার বলেছি—তুমি ব্যবসা করো, খেলাধুলা চালিয়ে যাও, সিনেমায় অভিনয় করো, এমনকি চাইলে রাজনীতিও করো, কিন্তু আওয়ামী লীগে যেও না। কারণ, এখনকার আওয়ামী লীগ আর বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ নয়। এটা দুর্নীতি আর দমন-পীড়নের প্রতীক হয়ে গেছে।” এই বক্তব্যের পরপরই ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে। বিএনপি সমর্থকরা এই বক্তব্যকে ‘সত্য প্রকাশ’ হিসেবে প্রচার করছে, অন্যদিকে আওয়ামী লীগপন্থীরা এটিকে ‘হতাশার বহিঃপ্রকাশ’ বলে আখ্যা দিয়েছে।

সাকিব আল হাসানের রাজনীতিতে প্রবেশ: পটভূমি

সাকিব আল হাসান ২০২৩ সালের শেষ দিকে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন নিয়ে মাগুরা-১ আসনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন। পরবর্তীতে তিনি জয়লাভ করেন এবং সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেন ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে। তবে তার রাজনীতিতে প্রবেশ নিয়ে শুরু থেকেই সমালোচনা ছিল। একদিকে তিনি তখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সক্রিয়, অন্যদিকে তার দলীয় সমাবেশে উপস্থিতি কিংবা নীতিগত অবস্থান অনেক সময় অস্পষ্ট থেকেছে। সাকিব নিজেও একাধিকবার বলেছেন, “আমি রাজনীতি করতে চাই দেশের উন্নয়নের জন্য, দল নয়, মানুষের পক্ষে কাজ করতে চাই।”

মেজর হাফিজের সঙ্গে সম্পর্ক: পূর্ব পরিচয়

সাকিবের গ্রামের বাড়ি মাগুরায় হলেও তার নানা বাড়ি পিরোজপুরে। মেজর হাফিজও পিরোজপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী নেতা। পারিবারিক সূত্রে বা সামাজিকভাবে দু’জনের মধ্যে পূর্ব পরিচয় থাকা অস্বাভাবিক নয়। টকশোর আলোচনায় হাফিজ বলেন, “সে (সাকিব) আমার ছোট ভাইয়ের মতো। ও যখন জাতীয় দলে প্রথম উঠল, তখন থেকেই আমি খেয়াল রাখতাম। রাজনীতি করার ইচ্ছা ওর বহুদিনের, কিন্তু আমি সবসময় সাবধান করেছি।” এ বক্তব্যের পর অনেকেই ধারণা করছেন, সাকিবের রাজনৈতিক পটভূমিতে হাফিজের কিছুটা ভূমিকা বা অন্তত উপদেশ ছিল।

আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া: ‘হতাশায় আচ্ছন্ন একজন বিএনপি নেতা

মেজর হাফিজের বক্তব্য নিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া এসেছে। দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেন,

“সাকিব একজন জনপ্রিয় খেলোয়াড় এবং নিজ যোগ্যতায় নির্বাচিত সংসদ সদস্য। হাফিজ সাহেবের এই মন্তব্য আসলে বিএনপির রাজনৈতিক দিশাহীনতার প্রমাণ। যাদের নিজেদের ঘরেই নেতৃত্ব সংকট, তারা এখন সাকিবকে নিয়ে কুৎসা রটাচ্ছেন।” আরও কঠোর ভাষায় কথা বলেন যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ পরশ, যিনি সামাজিক মাধ্যমে লেখেন, “যিনি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হতে পারেননি, তিনি আজ একজন সফল এমপিকে ছোট করার চেষ্টা করছেন। এটাই বিএনপির রাজনীতি।”

বিএনপির ভেতরে মতভেদ?

তবে মেজর হাফিজের বক্তব্য বিএনপির ভেতরে সামান্য অসন্তোষও সৃষ্টি করেছে বলে গুঞ্জন রয়েছে। দলের একজন শীর্ষ পর্যায়ের নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন:

“এ ধরনের ব্যক্তিগত পরামর্শ বা অভ্যন্তরীণ আলাপ সামনে আনা রাজনৈতিক কৌশলগত ভুল হতে পারে। আমাদের ফোকাস থাকা উচিত সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে।” অন্যদিকে, দলের ছাত্র সংগঠন ও যুবদলের অনেকে সামাজিক মাধ্যমে মেজর হাফিজের বক্তব্যের প্রশংসা করছেন।

ক্রিকেটপাড়ায় প্রতিক্রিয়া: ‘সাকিবের স্বাধীনতা থাকা উচিত

ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন, সাকিব কোন দলে যোগ দেবে সেটা তার নিজস্ব পছন্দের ব্যাপার। বিসিবি’র একজন কর্মকর্তা বলেন:

“একজন নাগরিক হিসেবে সে রাজনীতি করতেই পারে। তবে খেলোয়াড়দের নিয়ে এভাবে কথা বলা ঠিক নয়।” প্রাক্তন অধিনায়ক ও সাকিবের সতীর্থ মোহাম্মদ আশরাফুল বলেন, “সাকিবের রাজনৈতিক যাত্রা নিয়ে নানা মত থাকতেই পারে, কিন্তু ব্যক্তিগত আলাপকে এভাবে টেনে আনা সঠিক নয়।”

বিশ্লেষকদের মতামত: বক্তব্যের পেছনে রাজনৈতিক বার্তা

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. রাশেদুজ্জামান বলেন:

“মেজর হাফিজের বক্তব্য কেবল ব্যক্তিগত মত নয়, বরং রাজনৈতিক বার্তা বহন করে। এটি বোঝায় যে বিএনপি মনে করে সাকিবের মতো ব্যক্তিত্বকে আওয়ামী লীগ ব্যবহার করছে জনপ্রিয়তা বাড়াতে।” তিনি আরও বলেন, “এই বক্তব্য সেই ধারণাকে তুলে ধরতে চায় যে, আওয়ামী লীগ এখন আর রাজনৈতিক আদর্শ নয়, একটি প্রচারযন্ত্র মাত্র।”

জনমত: বিভক্ত সামাজিক মাধ্যম

এই বিতর্ক ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক মাধ্যমেও। ফেসবুক, টুইটার (এক্স), ইউটিউবের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে #SakibInPolitics এবং #MajorHafiz ট্রেন্ড করছে।

সমর্থনকারী মন্তব্য:

  • “হাফিজ সাহেব ঠিকই বলেছেন, সাকিবকে অন্ধকারে ফেলা হয়েছে।”
  • “ক্রিকেটারদের রাজনীতিতে আসা উচিত নয়।”

বিরোধী মন্তব্য:

  • “যার যোগ্যতা আছে সে রাজনীতি করতেই পারে।”
  • “হাফিজ নিজে ব্যর্থ, তাই এখন সাকিবকে হেয় করছেন।”

সামনে কী হতে পারে?

এই মন্তব্যের পর সাকিব আল হাসান এখনো প্রকাশ্যে কিছু বলেননি। তার ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, “সাকিব এখনো ক্রিকেট ক্যারিয়ারে মনোযোগী এবং কোনো ধরনের রাজনৈতিক বিতর্কে জড়াতে চান না।” তবে রাজনীতিতে প্রবেশের পর থেকে তাকে ঘিরে যেভাবে বিতর্ক তৈরি হচ্ছে, তা হয়তো তাকে কিছুটা সাবধান হতে বাধ্য করবে। আবার এটাও স্পষ্ট, শুধু জনপ্রিয়তা নয়, তার রাজনৈতিক অবস্থান এখন অনেকের নজর কাড়ছে।

উপসংহার: বিতর্কে না পড়েও বিতর্কের কেন্দ্রে

সাকিব আল হাসান কখনোই সরাসরি রাজনৈতিক ভাষা ব্যবহার করেননি, বরং নিজেকে “উন্নয়নের সাথী” হিসেবেই উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু রাজনীতিতে প্রবেশ মানেই যে বিতর্কের হাতছানি, সেটাই হয়তো এবার পরিষ্কার হয়ে গেল মেজর হাফিজের মন্তব্যে। এই ঘটনাটি একদিকে রাজনৈতিক শিবিরগুলোর কৌশল স্পষ্ট করে, অন্যদিকে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বদের রাজনীতিতে আনায় কী ধরনের চাপ তৈরি হয় তাও সামনে নিয়ে আসে। পরবর্তী দিনে সাকিবের অবস্থান কী হয়, আওয়ামী লীগ তাকে কতটা এগিয়ে রাখে, এবং বিএনপি এই ইস্যুকে কতটা কাজে লাগাতে পারে, তা রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top