লোহিত সাগরে যুক্তরাষ্ট্রের তেল পরিবহণ নিষিদ্ধ করল ইয়েমেন, উত্তেজনা চরমে

লোহিত সাগর ও বাব-আল-মানদেব প্রণালীর মতো গুরুত্বপূর্ণ জলপথে মার্কিন তেলবাহী জাহাজ চলাচল সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা। এই পদক্ষেপের ফলে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা নতুন করে বাড়ার পাশাপাশি বিশ্ব জ্বালানি বাজারে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

হুথি নেতৃত্বাধীন ইয়েমেনের ‘আনসারুল্লাহ’ গোষ্ঠীর সামরিক মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার ইয়াহিয়া সারিয়াহ এক বিবৃতিতে বলেন, “আমরা আর যুক্তরাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্যের তেল লুট করতে দেব না। যতক্ষণ পর্যন্ত ফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধ না হয় এবং গাজা অবরোধ তুলে নেওয়া না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত লোহিত সাগর দিয়ে কোনো মার্কিন জাহাজ চলতে পারবে না।”

ঘোষণার প্রেক্ষাপট: গাজা যুদ্ধ ইয়েমেনের অবস্থান

২০২৩ সালের শেষ ভাগে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরু হলে, ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা প্রকাশ্যে ফিলিস্তিনের পক্ষে অবস্থান নেয়। তারা শুরু থেকেই দাবি করে আসছিল যে, “গাজা অবরোধ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।” এরই ধারাবাহিকতায় তারা একাধিকবার ইসরায়েলগামী বা ইসরায়েল-সমর্থিত জাহাজে হামলা চালিয়েছে। তবে এবার হুথিরা সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের তেলবাহী জাহাজ লক্ষ্যবস্তু করার ঘোষণা দিল যা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বড় এবং ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ। তারা জানিয়েছে, এই সিদ্ধান্ত ‘অনির্দিষ্টকালের জন্য’ বলবৎ থাকবে এবং প্রয়োজনে সামরিকভাবে তা বাস্তবায়ন করা হবে।

লোহিত সাগর বাবআলমানদেব: কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?

লোহিত সাগর এবং সংযুক্ত বাব-আল-মানদেব প্রণালী বিশ্ব বাণিজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জলপথ। মধ্যপ্রাচ্যের তেলবাহী জাহাজগুলোর বড় অংশই এই রুট হয়ে ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ায় যায়। বিশেষ করে সৌদি আরব, ইরাক, কুয়েত ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের তেল রপ্তানির প্রায় ৩০% এই পথ দিয়ে পরিবাহিত হয়।

যে কোনো ধরনের সামরিক ও নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি সরবরাহ ব্যবস্থায় বড় ধাক্কা দেয়। ২০২৪ সালেই হুথিদের একাধিক ড্রোন হামলা ও জলদস্যু তৎপরতায় কয়েকটি ইউরোপীয় কোম্পানি লোহিত সাগর হয়ে চলাচল স্থগিত করে। বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন প্রায় ৭০ লাখ ব্যারেল তেল এই পথে চলাচল করে, যার বেশ কিছু অংশ যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি বাজারে সরাসরি প্রভাব ফেলে।

মার্কিন প্রতিক্রিয়া: হুথিদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আখ্যা

ওয়াশিংটন এই ঘোষণা ‘উস্কানিমূলক’ এবং ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ হিসেবে উল্লেখ করে নিন্দা জানিয়েছে। পেন্টাগনের মুখপাত্র জন কার্বি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র তার বাণিজ্যিক স্বার্থ এবং নাগরিকদের রক্ষা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমাদের সেনাবাহিনী প্রস্তুত রয়েছে।” এর আগে, হুথিদের হামলা ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র ‘অপারেশন প্রস্পেরিটি গার্ডিয়ান’ নামে একটি যৌথ নৌ টহল কার্যক্রম শুরু করে। এতে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, সৌদি আরবসহ প্রায় ১২টি দেশ অংশ নেয়।
তবে এই পদক্ষেপ হুথিদের রুখতে ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

বিশ্ব বাজারে প্রতিক্রিয়া: তেলের দাম বাড়ছে

ঘোষণার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৯০ ডলার ছাড়িয়েছে যা গত ছয় মাসে সর্বোচ্চ। বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাজারে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে যে, সরবরাহ ব্যাহত হলে তেলের দাম আবার ১০০ ডলার ছাড়াতে পারে। বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি যখন নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু করেছে, তখন এমন ঘোষণা নতুন করে চাপ সৃষ্টি করবে। বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ-এর পক্ষ থেকেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।

লন্ডনের এক জ্বালানি বিশ্লেষক, স্যামুয়েল অ্যান্ডারসন বলেন:
“একটি ঘোষণা বিশ্বের জ্বালানি চক্রকে কাঁপিয়ে দিতে পারে, সেটাই ঘটেছে। ইয়েমেন ছোট দেশ হলেও লোহিত সাগরের মুখে তাদের অবস্থান অত্যন্ত কৌশলগত। এ কারণেই হুথিদের হুমকি কেবল বাগাড়ম্বর নয়, বাস্তব।”

ইরান রাশিয়ার অবস্থান

হুথিদের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক বহু পুরনো। বিশ্লেষকদের মতে, ইরান পরোক্ষভাবে হুথিদের এই পদক্ষেপে উৎসাহ দিচ্ছে। তেহরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “লোহিত সাগরে যুক্তরাষ্ট্রের অনৈতিক সাম্রাজ্যবাদী আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ন্যায্য।” এদিকে রাশিয়াও হুথিদের ঘোষণাকে আমেরিকার ‘ব্যর্থ নীতির ফল’ বলে মন্তব্য করেছে। তবে চীন এখনো এ বিষয়ে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে।

সামরিক উত্তেজনার শঙ্কা

বিশ্লেষকেরা আশঙ্কা করছেন, হুথিদের এই ঘোষণা ও ভবিষ্যৎ হামলা যদি চলতে থাকে, তাহলে সরাসরি সামরিক সংঘর্ষ শুরু হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি যুদ্ধজাহাজ বর্তমানে আরব সাগরে অবস্থান করছে। প্রয়োজনে তারা লোহিত সাগরে প্রবেশ করতে পারে। তবে কিছু বিশ্লেষক বলছেন, হুথিদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হলেও তাদের আত্মঘাতী ড্রোন ও জলযান বেশ কার্যকর। তারা ২০২৪ সালেই একাধিক ব্রিটিশ ও জাপানি ট্যাংকারে হামলা চালিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল।

আঞ্চলিক আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

ইসরায়েল:
ইসরায়েল সরকার এই ঘোষণাকে ‘হুথিদের সন্ত্রাসী চরিত্রের প্রকাশ’ বলে মন্তব্য করেছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা মার্কিন নেতৃত্বাধীন টহল মিশনে আরও সমর্থন দেবে।

সৌদি আরব সংযুক্ত আরব আমিরাত:
এই দুই দেশ হুথিদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করছে। তারা এই ঘোষণাকে ‘বাণিজ্যিক মুক্ত চলাচলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী হুমকি’ বলেছে।

মিশর সুদান:
যেহেতু সুয়েজ খাল লোহিত সাগরের উত্তর অংশে অবস্থিত, তাই এই ঘোষণা মিশরের জন্যও উদ্বেগের। মিশর জানিয়েছে, বাণিজ্যিক জাহাজের নিরাপত্তা রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জাতিসংঘ ও নিরাপত্তা পরিষদ:
জাতিসংঘ উদ্বেগ জানিয়ে বলেছে, হুথিদের এমন ঘোষণায় সমুদ্রপথে মানবিক সহায়তা পাঠানোও ব্যাহত হতে পারে। নিরাপত্তা পরিষদে আগামী সপ্তাহে এই ইস্যুতে একটি বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করা হয়েছে।

বিশ্লেষণ: পরিণতি কী হতে পারে?

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, হুথিদের এই ঘোষণা মূলত রাজনৈতিক চাপ তৈরি করতেই দেওয়া হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে তারা এর পরিণতি সম্পর্কে সচেতন। তবে মার্কিন প্রশাসনের জন্য এটি একটি কঠিন সিদ্ধান্তের মুহূর্ত। একদিকে তারা গাজার ইস্যুতে ইসরায়েলকে সমর্থন দিচ্ছে, অন্যদিকে লোহিত সাগরে তেল চলাচল ব্যাহত হলে তাদের নিজের অর্থনীতি চাপে পড়বে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিংকট্যাঙ্ক ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনএর বিশ্লেষক ড্যানিয়েল সাইমন্স বলেন:
“হুথিরা বুঝতে পেরেছে, এখন তারাই মধ্যপ্রাচ্যের গেমচেঞ্জার। এ কারণে তারা সময় বুঝে বড় চাল দিয়েছে। এটি যদি সামাল দেওয়া না যায়, তাহলে যুদ্ধ অনিবার্য।”

উপসংহার: এক ঘোষণায় কাঁপছে বিশ্ব

ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা ছোট একটি গোষ্ঠী, কিন্তু তাদের অবস্থান, কৌশল ও সাহস বিশ্ব রাজনীতিতে বড় প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে। লোহিত সাগর বন্ধ মানে শুধু তেল সরবরাহ ব্যাহত হওয়া নয়, এটি মানে বৈশ্বিক অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সামরিক ভারসাম্য নতুন করে ঝুঁকির মুখে পড়া। এখন বিশ্ব অপেক্ষা করছে যুক্তরাষ্ট্র কী পদক্ষেপ নেয়? হুথিরা কি শুধু হুমকিতে থেমে থাকবে, নাকি আসলেই হামলা চালাবে? আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন: এই উত্তেজনা কি বড় কোনো যুদ্ধের দিকে এগোচ্ছে?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top