
২০২৪ সালের জুলাই মাসের এক সন্ধ্যায়, ঢাকার আকাশজুড়ে ভেসে উঠল প্রতিবাদের এক ব্যতিক্রমী ভাষা। কারওয়ান বাজারের ওপরে, জাতীয় প্রেস ক্লাব থেকে শুরু করে শিল্পাঞ্চলগুলোর দিকে তাকানো মানুষজন দেখল ড্রোনে তৈরি এক আকাশময় দৃশ্যপট, যেখানে ভেসে উঠছে এক বিস্মৃত কিন্তু অনির্বাণ প্রতিরোধের চিত্র ১৯৭১ সালের জুলাই অভ্যুত্থান।
এই ড্রোন প্রদর্শনী ছিল শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত কৃতিত্ব নয়; এটি ছিল একটি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঘোষণা আমাদের শোষিত অতীত ভুলিনি, ভবিষ্যৎকেও ভুলতে দেব না।
জুলাই ১৯৭১: যে অভ্যুত্থান রাষ্ট্র লিখতে চায়নি
১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই, স্বাধীনতার পর মাত্র ছয় মাসের মাথায়, দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে শ্রমিকদের গর্জে ওঠা আন্দোলন নতুন রাষ্ট্রকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। মজুরি, নিরাপত্তা, সম্মান এই তিন দাবি ঘিরেই রাস্তায় নেমেছিলেন হাজার হাজার শ্রমজীবী মানুষ।
রাষ্ট্র তখন সদ্য প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল। ফলে সেই আন্দোলন দমন হয় গুলি, গ্রেপ্তার, এবং নিপীড়নের মাধ্যমে। শতাধিক শ্রমিক নিহত হন, অনেককে গুম করা হয়।
এই অভ্যুত্থান রাষ্ট্রীয় ইতিহাসের পাতায় জায়গা পায়নি কিন্তু শ্রমিকদের স্মৃতিতে থেকে গেছে অমলিন।
২০২৪ সালের আয়োজন: ড্রোনে আঁকা ইতিহাস
জুলাই ২০২৪-এ, ঐতিহাসিক ওই দিনটিকে ঘিরে একদল শিল্পী, ডিজাইনার, গবেষক ও শ্রমিক অধিকার কর্মী আয়োজন করেন একটি “ড্রোন প্রতিবাদ প্রদর্শনী“। পুরো প্রকল্পটির নাম ছিল “আকাশে প্রতিরোধ”।
প্রদর্শনীটি হয় একাধিক ধাপে:
- সন্ধ্যা ৭টা থেকে ৮টা পর্যন্ত আকাশে ড্রোনের মাধ্যমে চলতে থাকে ভিজ্যুয়াল শো
- শহরের বিভিন্ন শ্রম অঞ্চল টঙ্গী, মিরপুর, আশুলিয়া ও নারায়ণগঞ্জে ড্রোন পাঠিয়ে ধারণ করা হয় বর্তমান শ্রমিক বাস্তবতা
- এসব চিত্র যুক্ত করা হয় ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর আর্ট ফর্ম ও ভিডিও ইনস্টলেশনের সঙ্গে
ড্রোনগুলো প্রদর্শন করে:
- শ্রমিকদের মুখ
- ১৯৭১ সালের জেলখানার দলিলের ছায়া
- আর আকাশজুড়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা স্লোগান:
“তোমার শোষণ যত পুরোনো, আমাদের প্রতিরোধ তত নবীন।”
দর্শকদের প্রতিক্রিয়া: আকাশ হয়ে উঠল স্মৃতির পর্দা
ড্রোন প্রদর্শনী দেখতে ভিড় করে নানা বয়সী মানুষ। কেউ মোবাইলে ভিডিও করছে, কেউ কেবল স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। একজন প্রবীণ শ্রমিক নেত্রী বলেন,
“যেখানে সরকার আমাদের ইতিহাস মুছে দিতে চেয়েছে, সেখানে আজ আকাশে আমাদের গল্প ভেসে উঠছে।”
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মিম বলেন,
“আমরা অনেকেই জানতাম না এই অভ্যুত্থানের কথা। ড্রোনের মাধ্যমে যখন সেই ইতিহাস দেখলাম, মনে হলো—এটা আমাদের জানা উচিত ছিল আরও আগে।”
প্রযুক্তি ও প্রতিবাদ: ভবিষ্যতের নতুন রূপ
এই আয়োজন প্রমাণ করেছে যে প্রতিবাদের ভাষা বদলেছে, কিন্তু তার প্রয়োজন বদলায়নি। ড্রোন এখানে নিছক খেলনা বা নজরদারির যন্ত্র নয় এটি হয়ে উঠেছে ইতিহাস রক্ষার মাধ্যম, চেতনার বাহক।
শিল্পী সংগঠন ‘প্রতিস্রোত’ ও শ্রমিক গবেষণা কেন্দ্র এই প্রকল্পের নেপথ্যে ছিল। তাদের ভাষায়,
“আমরা চাইনি মানুষ শুধু আকাশে আলো দেখুক। আমরা চেয়েছি তারা নিজেদের অতীত, ভুলে যাওয়া লড়াই এবং চলমান নিপীড়নকে দেখে আবার ভাবুক।”
উপসংহার: ইতিহাস মুছে যায় না, তা শুধু রূপ বদলায়
জুলাই ২০২৪-এর এই ড্রোন প্রদর্শনী আমাদের মনে করিয়ে দিল প্রতিটি প্রতিরোধ একটি গল্প, এবং প্রতিটি গল্প একদিন না একদিন আকাশে উড়ে আসে। ইতিহাস চাপা পড়ে না, চুপচাপ অপেক্ষা করে… যখন কেউ আঙুল তোলে, প্রশ্ন তোলে, বা ড্রোন ওড়ায়।
আকাশে প্রতিবাদের ছবি মানে শুধু শো নয় এ এক নীরব চিৎকার, যা বলছে:
“আমরা ভুলিনি। ভুলতেও দেব না।”